জয়নাল আবেদীন :
রিকসাভ্যান পাশে ঠেলে চায়ের দোকানে ঢুকলো রতন বাগদী (৫৫)। সামনের দুই বেঞ্চিতে কম বয়সী ছোড়ারা আয়েশে পা তুলে সিগারেট ফুঁকছিল। সারির শেষ বেঞ্চের কোনায় জড়োসড়ো হয়ে বসলো সে। নাতি বয়সী হোটেল বয়কে কাকাবাবু সম্বোধন করে চা দেয়ার অনুরোধ জানালো। হোটেল বয় ছোটন শুনেও না শোনার ভান করলো। এর মধ্যে আরো ক‘জন চা‘খোর ঢুকলো স্টলে। মাঝের বেঞ্চের খালি আসনে বসা মাত্র চা পেলো তারা। মিনিট দশেক পর রতন আবার হাঁক দিল ‘কাকু চা চাইছিলাম। ভুইলা গেইছেন নাকি? এবার স্টল বয় ছোটন ধমকের সুরে বললো, এত জুলুম কেনে? তোমারে না মালিক কইছে বেশি ভির থাকলে দোহানে আইবানা। অহন চুপ কইরা বস। ভির কমলে চা পাইবা।’ ছোটন চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে আলমিরার পেছন থেকে রংচটা হাতল ভাঙ্গা কাপ বের করলো। কোনোভাবে জলছিটা দিয়ে চায়ের পানি েেঢলে রতনের সামনে ধপাস করে রাখলো কাপ। রংচটা কাপের গরম পানি নাকেমুখে ঢেলে বেরিয়ে গেল রতন। এর মধ্যে রিকসাভ্যানের দুই প্যাসেঞ্জার জুটলো। বয়স ২০/২৫ বছর। বললো, ‘এই রতন যাবি নাকি পিংনা। গেলে আয়। বিশ টাকা ভাড়া পাবি।’ ওই দুই যাত্রীকে ভ্যানে তুলে ছুটলো রতন বাগদী। এটি কোনো গল্প নয়। গত বুধবার গোপালপুর উপজেলার ভেঙ্গুলা বাজার মোড়ে এক চায়ের দোকানের ঘটনা এটি। নিচু জাতের বলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির বাগদীরা হরহামেশাই এভাবে সামাজিক বঞ্চনা ও উপেক্ষার শিকার হয়। প্রবীণরা তো বটেই ছেলেছোকরা পর্যন্ত বাগদীদের তুইতোকারি সম্বোধন করে।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এ উপজেলার হেমনগর, ভেঙ্গুলা, ঝাওয়াইল ও পৌরশহরের নন্দনপুরে প্রায় তিনশ ঘর বাগদী বাস করে। ওরা অর্থনৈতিকভাবে যেমন পিছিয়ে তেমনি সামাজিকভাবে অবহেলিত ও বঞ্চিত। লেখাপড়ায় একদম পিছিয়ে ওরা। এ জন্য বঞ্চনার মাত্রাও বেশি। গোপালপুর-পিংনা সড়কের মাঝে অবস্থিত প্রাচীন ব্যবসা কেন্দ্র ভেঙ্গুলা বাজার। বাজারে প্রবেশের আগে হাতের বামে ঝিনাই নদীর পূর্ব তীরে বাস চল্লিশ ঘর বাগদীর। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ধনবাড়ির জমিদার ভারতের বিহার থেকে বিশ ঘর বাগদীকে চাকরির প্রলোভনে এনে ভেঙ্গুলা বাজারের পশ্চিম প্রান্তে খাস জমিতে পুনর্বাসিত করে। এর আগে নীলকর সাহেবদের স্ফূর্তির জন্য গড়ে উঠে নিষিদ্ধ পল্লী। হেমনগর জমিদারের সাথে সীমানা নিয়ে বিরোধ ছিল ধনবাড়ি জমিদারের। হেমনগর জমিদারের দেখাদেখি ধনবাড়ির জমিদাররাও লাঠিয়াল হিসাবে বাগদীদের এখানে পুনর্বাসন করে।
বাগদীরা গায়েগতরে তেজি ও সাহসী থাকায় ওই দুই জমিদার ছাড়াও নবগ্রাম, নন্দনপুর ও নগদাশিমলার হিন্দু সামন্ত প্রধানরা এদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতো। এভাবে বাগদীদের কদর বেড়ে যায়। লাঠিয়াল ছাড়াও বাগদীরা বেহারা হিসাবে পালকি টানার কাজ করতো। জমিদার থেকে নায়েব-গোমস্তরা বাগদীদেও কাঁধে চড়ে এলাকা পরিদর্শন করতো। এভাবে গোপালপুরের হেমনগর, ঝাওয়াইল, ভেঙ্গুলা ও নন্দনপুরে এবং ভূয়াপুরের কুটির বয়রা মৌজার খাস জমিতে গড়ে উঠে বাগদী পল্লী। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর অনেক বাগদী পরিবার ওপারে চলে যায়। যারা ছিল তারা জমিদার প্রথা উচ্ছেদের পর বেকায়দায় পড়ে। লাঠিয়ালী ও পালকি বহনের চাকরি চলে যায়। খাস জমির বাড়িভিটে প্রভাবশালীরা জবরদখল শুরু করলে অনেকেই ছিন্নমূল হয়ে পড়ে।
ভেঙ্গুলা বাগদী পল্লীর কার্ত্তিক চন্দ্র জানান, জমিদার প্রথা উচ্ছেদের পর বাগদীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের জীবিকা বন্ধ হয়ে যায়। উচ্ছেদের পর অনেকে ভবঘুরে জীবনযাপন শুরু করে। জঙ্গলের আলু সংগ্রহ আর বণ্য প্রাণী শিকারকে ক্ষুন্নবৃত্তি নিবারণে বেছে নেয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ভেঙ্গুলা বাজার জা¦লিয়ে দেয়। বাগদী পল্লী নিশ্চিহ্ণ হয়ে যায়। জান হাতে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে এসে কোনো সরকারি সাহায্য পায়নি। স্বাধীনতার ৪৫ বছরে তিন দফা উচ্ছেদের শিকার হয় বাগদীরা। ঝাওয়াইল বাজারের বাগদী পল্লীতে অগ্নিসংযোগ করে ভিটেমাটি দখলে নেয় প্রভাবশালীরা।
উপজেলা প্রশাসণ শুধু মাত্র ভেঙ্গুলা বাজারের বাগদীদের কয়েক বছর আগে নদীর পূর্ব তীরে খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়ে পুনর্বাসণের ব্যবস্থা করে। ভেঙ্গুলা ব্যতিত আর সব বাগদী পল্লীর বাসিন্দারা খাস জমিতে বাস করে। প্রতি বছরই তাদের বসতভিটার খাস জমি নানা অছিলায় জবরদখল করছে প্রভাবশালীরা। গোপালপুর উপেজলা আদিবাসি সমিতির সম্পাদক ভজন চন্দ্র জানান, বাগদীদের সামাজিকভাবে কোনো সম্মান নেই। সুযোগ পেলেই লোকে ছোটজাত বলে গালি দেয়। ওদেও অচ্ছুত আর ছোটজাত ভাবে। হোটেলরেস্তোরায় ইচ্চেমতো ঢুকে খাবার বা চা নাস্তা করার অনুমতি দেয়না কোনো কোনো দোকানি। ওদের জন্য কোনো কোনো হোটেল রেস্তোরায় রয়েছে আলাদা থাল-গ্লাস ও কাপ। দারিদ্রপীড়িত বাগদী শিশুরা বাবামার সাথে রাতদিন কাজ করে। এ জন্য স্কুলে যাওয়ার ফুরসত পায়না। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে আদি বসন্ত উৎসব, হাড়ি গান, দঙ্গল নৃত্য। অভাব দারিদ্রতার দরুন শিব পূজা ও বন দেবতার পুজা হয়ে উঠেনা।